,

রাজাকারের প্রথম তালিকা প্রকাশ

বিডিনিউজ টেন ডেস্ক: রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটিসহ স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ ব্যক্তির নামের তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে স্থান পেয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা।

সরকারি নথির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তালিকাটি প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস তাদের স্থানীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সহায়তায় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

এ সময় তারা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা এবং দুই লাখ মা-বোনের সন্ত্রমহানি করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে সেই সব স্বাধীনতাবিরোধীর মধ্যে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের প্রথম তালিকা প্রকাশ করা হল।

ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে (www.molwa.gov.bd) তালিকাটি দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুরো তালিকা প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, আমরা কোনো তালিকা তৈরি করছি না। যারা একাত্তরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যেসব পুরনো নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল সেটুকু প্রকাশ করছি। এরপরও যেসব দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যাবে, তার ভিত্তিতেই নাম প্রকাশ করা হবে। কোনো তালিকা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে প্রকাশ করা হবে না। অন্যায়ভাবে কেউ তালিকাভুক্ত হবে না।’

তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে কিনা জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কোনো গেজেট প্রকাশ করা হবে না। তবে জাতি প্রত্যাশা করলে এবং সরকার মনে করলে গেজেট করবে। আমরা তালিকা প্রকাশ করলাম, আগে রি-অ্যাকশনটা দেখব, জাতি চাইলে এটা হবে।’

রাজাকারদের চেয়েও যারা উচ্চ পদে ছিল অর্থাৎ পিস কমিটির সভাপতি বা অন্য পদধারীদের নামের তালিকাও প্রকাশ করা হবে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি বলেন, আপনারা যাদের ইঙ্গিত করে এ প্রশ্ন করছেন তিনি রাজাকার নন, পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আপনি যদি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে ইঙ্গিত করেন, পরবর্তীকালে যিনি মন্ত্রী, স্পিকার, রাষ্ট্রপতি- সবই হয়েছিলেন। তিনি বরিশালে পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন। পিস কমিটি কিন্তু রাজাকার ছিল না। এরা আরও হায়ার। আরও অনেক বড় দালাল। তবে তারা রাজাকার ছিল না। তারা ছিল উচ্চপর্যায়ের।

মন্ত্রী বলেন, আইনে একটা কথা আছে, ১০টা অপরাধী যদি বেঁচেও যায় তবুও যেন একজন নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি না হয়। তাই আমরা চাই না কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে এ কলঙ্কজনক তালিকায় নিয়ে আসতে। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সচেতন। আমি জাতিকে আশ্বস্ত করতে চাই অন্যায়ভাবে কেউ এ তালিকায় আসবে না। ইতিমধ্যে এ তালিকার বিষয়ে শত শত মানুষ আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন যে, কতজনের তালিকা, তালিকায় কারা কারা আছেন?

আমার মনে হয় এ বিষয়টা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। তাই আমি বলছি, সরকারের কাছে সংরক্ষিত তালিকার বাইরে কেউ যদি কোনো নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে চান, সেটা গ্রহণ করব না। অনেকে রাজাকারদের তালিকা দিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, আবার জেলাভিত্তিক তালিকা তৈরি করেছেন। আমরা সেগুলোকে তথ্য হিসেবে নেব। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমরা সেটা সরকারিভাবে প্রকাশ করব না। তিনি বলেন, আগামীতে যাদের নাম এ তালিকায় আসবে, তাদের (অভিযুক্ত) কথা শোনা হবে। তারপর তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যদি কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ থেকে থাকে, তাহলে এই তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাদের বিচারের দ্বার উন্মোচিত হবে বলে তার বিশ্বাস। তালিকাভুক্ত হলে মামলা করা যাবে বা তালিকাভুক্ত না হলে মামলা করা যাবে না এমন নয়। বাদী অভিযোগ আনলে মামলা হবে। আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সঙ্গে এই তালিকার সম্পর্ক নেই। ট্রাইব্যুনাল আছেন। যদি কেউ বাদী হয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনেন, তবে মামলা হবে। এ তালিকা করা হয়েছে, কারণ ’৭১ সালে কার কী ভূমিকা ছিল, জাতির তা জানা প্রয়োজন। প্রথম ধাপের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় চিহ্নিত করা হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বেচ্ছায় যারা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন তারাও স্বাধীনতাবিরোধী।

প্রথম দফার তালিকায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান, জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমসহ ওই সময় স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী অনেক রাজনৈতিক নেতার নাম আছে। নানা ক্যাটাগরিতে এদের নাম একাধিকবার তালিকায় এসেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- নুরুল আমীন, খান এ সবুর, মাহমুদ আলী, ওয়াহিদুজ্জামান, খাজা খায়রুদ্দিন, কাজী আবদুল কাদের, রাজা ত্রিদিব রায়, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, একেএম সামসুল হক, অংশু প্রু চৌধুরী, আব্বাস আলী খান, একিউএম শফিকুল ইসলাম, সৈয়দ সাজ্জাব হোসাইন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মো. আলমগীর, লাল মিয়া, আলী হায়দার মোল্লা, এটিএম আবদুল মতিন, মোহাম্মদ আলী, শহিদুল্লাহ, আনম ইউসুফ, শামসুল হুদা, এমএ মতিন, খররম জা মুরদাদ, এমএ শিকদার, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, সেরাজুদ্দীন, আজগর হোসেন প্রমুখ।

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, সব ধরনের তালিকা যাচাই-বাছাই করে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার প্রাথমিক খসড়া আমাদের কাছে আছে। বর্তমান তথ্যমতে, কোনো না কোনো তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৫৬ জন। এর মধ্যে দাবিদার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫ জন। বর্তমানে ২ লাখ ১ হাজার ৪৬১ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন। তবে একজনের নাম একাধিক দলিলে রয়েছে। এজন্য মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি নয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী জানান, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম পাঁচ জায়গায় রয়েছে। যাদের নাম একাধিক তালিকায় রয়েছে তা বাদ দেয়ার কাজ চলছে। একই নাম একাধিক বানানে লেখার কারণে একাধিকবার সেসব নাম ছাপা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া তুলে ধরে মোজাম্মেল হক বলেন, এর আগে আইন লংঘন করে ৪৪ হাজার জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। পরে আইনের মধ্যে তালিকা প্রস্তুতের উদ্যোগ নেয়া হয়।

স্বাধনীতার পর গত ৪৮ বছরে ছয়বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ‘প্রকৃত’ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, আবেদনকৃত ও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরীক্ষণ এবং তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে উপজেলা, জেলা/মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি করেছে সরকার।

এ কাজে চারটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ঠিক হয়, ভারতীয় তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা, বেসামরিক গেজেট ও বাহিনীর গেজেট- এই চারটি তালিকার অন্তত একটিতে নাম থাকলে তবেই একজন ব্যক্তির নাম আসবে চূড়ান্ত তালিকায়। এরপর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা চূড়ান্ত করতে সরকার সারা দেশে ৪৭০টি উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে।

কিন্তু আইনি জটিলতায় ১১৬টি কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। আবার অনেক কমিটির প্রতিবেদনে অসঙ্গতি ও ভুল-ত্রুটি থাকায় বিভিন্ন উপজেলা থেকে আপত্তি আসায় অসঙ্গতি দূর করতে গঠন করা হয় আরেকটি কমিটি। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের শেষ বছর ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ এই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক। কিন্তু নানা জটিলতায় তা আর হয়নি।

এই বিভাগের আরও খবর